ইসলামে পরকীয়াকে "যিনা" বা ব্যভিচার হিসেবে গণ্য করা হয় এবং এটি একটি গুরুতর অপরাধ (কবিরা গুনাহ)। এর জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। তবে পরকীয়া এবং ব্যভিচারের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে, যা ইসলামি আইনে শাস্তির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
পরকীয়া ও ব্যভিচারের পার্থক্য (ইসলামী দৃষ্টিকোণ)
* পরকীয়া: বিবাহিত নারী বা পুরুষের অন্য কোনো স্বামী বা স্ত্রীর সাথে প্রেম বা প্রণয়কে পরকীয়া বোঝায়। এটি যৌন সঙ্গম পর্যন্ত গড়াতেও পারে, নাও পারে। পরকীয়া গভীর যোগাযোগ, দেখা-সাক্ষাৎ, হাসি-তামাশা ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে।
* ব্যভিচার (যিনা): বিবাহবহির্ভূত যৌন সঙ্গমকে ব্যভিচার বা যিনা বলা হয়। অর্থাৎ, পরকীয়া যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে শারীরিক মিলনে পৌঁছায়, তখন তা ব্যভিচারে রূপান্তরিত হয়। ইসলামে "যিনা"র জন্য সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধান রয়েছে।
ইসলামে, ব্যভিচার (যিনা) এমন একটি মহাপাপ, যা সকল পাপের উৎপত্তিস্থল এবং হত্যার পরই এর অবস্থান।
ইসলামে ব্যভিচারের (যিনা) শাস্তি
ব্যভিচারে লিপ্ত ব্যক্তির বৈবাহিক অবস্থা অনুযায়ী ইসলামে শাস্তির বিধান ভিন্ন হয়:
* অবিবাহিত ব্যভিচারী (পুরুষ বা নারী):
* পবিত্র কুরআন (সূরা নূর, আয়াত ২) অনুযায়ী, অবিবাহিত ব্যভিচারী পুরুষ ও নারীকে ১০০টি বেত্রাঘাত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
* কিছু আলেমের মতে, এর সাথে এক বছরের জন্য নির্বাসনের বিধানও রয়েছে, যদিও এ বিষয়ে আলেমদের মধ্যে মতানৈক্য আছে।
* বিবাহিত ব্যভিচারী (পুরুষ বা নারী):
* ইসলামী শরিয়তে বিবাহিত ব্যভিচারী নারী ও পুরুষের জন্য শাস্তি হলো পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড (রজম)। এই শাস্তি কুরআন থেকে সরাসরি উল্লেখিত না হলেও, অসংখ্য সহীহ হাদীস এবং সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর আমল দ্বারা এটি প্রমাণিত। এটি "হুদুদ" (আল্লাহর নির্ধারিত সীমা) এর অন্তর্ভুক্ত শাস্তি।
শাস্তি কার্যকরের শর্তাবলী
ইসলামী শরিয়তে ব্যভিচারের শাস্তি কার্যকর করার জন্য অত্যন্ত কঠোর প্রমাণ প্রয়োজন:
* চারজন বিশ্বস্ত সাক্ষী: চারজন ন্যায়পরায়ণ মুসলিম পুরুষকে সরাসরি ব্যভিচারের ঘটনাটি দেখতে হবে, যেভাবে সুরমায় কাঠি প্রবেশ করে। এটি অত্যন্ত কঠিন শর্ত, যা বাস্তবে প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব।
* স্বীকারোক্তি: ব্যভিচারে লিপ্ত ব্যক্তির স্বেচ্ছামূলক, স্পষ্ট এবং একাধিকবার স্বীকারোক্তি। তবে, সাধারণত ইসলামে স্বীকারোক্তির পরিবর্তে তওবা ও ক্ষমা চাওয়ার উপর বেশি জোর দেওয়া হয়।
যদি এই কঠোর প্রমাণ না থাকে, তাহলে দুনিয়াতে শরিয়তের নির্দিষ্ট শাস্তি কার্যকর করা হয় না। তবে, এটি আল্লাহর কাছে একটি গুরুতর গুনাহ হিসেবেই বিবেচিত হয় এবং আখেরাতে এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
পরকীয়ার (যা যিনা পর্যন্ত না গড়ায়) শাস্তি
যদি পরকীয়া কেবল প্রেম, প্রণয়, গভীর যোগাযোগ, দেখা-সাক্ষাৎ, হাসি-তামাশা ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং তা ব্যভিচার (যিনা) পর্যন্ত না গড়ায়, তাহলে এর জন্য নির্দিষ্ট কোনো "হুদুদ" (আল্লাহর নির্ধারিত) শাস্তি নেই। তবে, এটি নৈতিকভাবে গুরুতর অপরাধ এবং এর জন্য "তা'যীর" (বিচারকের বিবেচনামূলক শাস্তি) হতে পারে। বিচারক সমাজের প্রচলিত আইন, অপরাধের গুরুত্ব এবং অপরাধীর অবস্থা বিবেচনা করে উপদেশ, তিরস্কার, বা ছোটখাটো শারীরিক শাস্তি (যেমন অল্প কিছু বেত্রাঘাত) প্রদান করতে পারেন। মূল উদ্দেশ্য হলো ভবিষ্যতে এ ধরনের অনৈতিক কাজ থেকে বিরত রাখা।
ইসলামে ব্যভিচার প্রতিরোধের উপায়
ইসলাম ব্যভিচারকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি এর কারণগুলো দূর করার উপরও জোর দিয়েছে:
* দৃষ্টি সংযত রাখা: পুরুষ ও নারী উভয়কেই পরনারীর প্রতি বা পরপুরুষের প্রতি দৃষ্টি সংযত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। (সূরা নূর: ৩০-৩১)
* পর্দা: নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য শালীন পোশাক এবং পর্দার বিধান রয়েছে, যা ফিতনা থেকে রক্ষা করে।
* যৌবনের শুরুতেই বিবাহ: যুবক-যুবতীদের সামর্থ্য থাকলে তাড়াতাড়ি বিবাহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা যিনায় লিপ্ত না হয়।
* অন্তরকে পরিচ্ছন্ন রাখা: মনের মধ্যে মন্দ চিন্তা ও কামনা-বাসনাকে প্রশ্রয় না দেওয়া।
* সামাজিক সচেতনতা: ব্যভিচারের কুফল সম্পর্কে সমাজকে সচেতন করা এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
পরকীয়া বা ব্যভিচার কেবল ব্যক্তিগত পাপ নয়, এটি পরিবার, সমাজ এবং বংশের পবিত্রতাকে নষ্ট করে দেয়। তাই ইসলামে এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছে।
Post a Comment