জ'রা'য়ু সিস্ট থাকলে করনীয় কি
জরায়ুতে সিস্ট, যা সাধারণত ডিম্বাশয়ের সিস্ট (Ovarian Cyst) নামেই পরিচিত, এটি মহিলাদের মধ্যে বেশ প্রচলিত একটি সমস্যা। জরায়ু এবং ডিম্বাশয় যদিও আলাদা অঙ্গ, কিন্তু অনেক সময় সাধারণ মানুষ জরায়ু সিস্ট বলতে ডিম্বাশয়ের সিস্টকেই বোঝান। এই সিস্টগুলো সাধারণত ডিম্বাশয়ের মধ্যেই তৈরি হয়।
ডিম্বাশয়ের সিস্ট কী এবং কেন হয়?
ডিম্বাশয়ের সিস্ট হলো ডিম্বাশয়ের ভেতরে বা উপরে তরল-ভর্তি থলির মতো এক ধরনের গঠন। বেশিরভাগ সিস্টই কার্যকরী সিস্ট (Functional Cysts), যা মাসিক চক্রের স্বাভাবিক অংশ হিসেবে তৈরি হয় এবং সাধারণত কয়েক মাসের মধ্যে নিজে থেকেই মিলিয়ে যায়। এ ধরনের সিস্ট সাধারণত নিরীহ এবং কোনো গুরুতর সমস্যা করে না।
তবে, কিছু সিস্ট অন্য কারণে তৈরি হতে পারে, যেমন:
* ডার্ময়েড সিস্ট (Dermoid Cysts): টিস্যু, চুল, দাঁত বা চর্বিযুক্ত সিস্ট।
* সিস্টাডেনোমাস (Cystadenomas): ডিম্বাশয়ের পৃষ্ঠের কোষে তৈরি হওয়া সিস্ট।
* এন্ডোমেট্রিওমাস (Endometriomas): জরায়ুর ভেতরের টিস্যু ডিম্বাশয়ে বেড়ে উঠলে এই সিস্ট তৈরি হয়।
* পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS): অসংখ্য ছোট সিস্ট ডিম্বাশয়ে তৈরি হয়, যা হরমোনের ভারসাম্যহীনতার সাথে সম্পর্কিত।
জরায়ু/ডিম্বাশয়ের সিস্ট থাকলে করণীয় কী?
ডিম্বাশয়ের সিস্ট ধরা পড়লে কী করা উচিত তা সিস্টের ধরন, আকার, আপনার বয়স, উপসর্গ এবং ভবিষ্যতের গর্ভধারণের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে।
১. অবিলম্বে ডাক্তারের পরামর্শ নিন
যদি আপনার পেটে ব্যথা, পেট ফাঁপা, অস্বাভাবিক রক্তপাত, অথবা মাসিকের অনিয়মের মতো কোনো লক্ষণ দেখা যায় বা আলট্রাসনোগ্রাফিতে সিস্ট ধরা পড়ে, তাহলে দ্রুত একজন গাইনোকোলজিস্টের (স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ) পরামর্শ নেওয়া জরুরি। নিজে নিজে কোনো অনুমান না করে চিকিৎসকের মাধ্যমে সঠিক রোগ নির্ণয় করানো উচিত।
ডাক্তার আপনার শারীরিক পরীক্ষা করবেন এবং সিস্টের ধরন ও অবস্থা বোঝার জন্য কিছু পরীক্ষা দিতে পারেন:
* আলট্রাসনোগ্রাফি (Ultrasound): এটি সিস্টের আকার, গঠন (তরল, কঠিন বা মিশ্র), এবং অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেয়। এটিই সবচেয়ে সাধারণ পরীক্ষা।
* ব্লাড টেস্ট (Blood Test): কিছু নির্দিষ্ট মার্কার (যেমন CA-125) পরীক্ষা করা হতে পারে, বিশেষ করে মেনোপজ-পরবর্তী মহিলাদের ক্ষেত্রে, যদি ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে। তবে, CA-125 সব সময় ক্যান্সারের নির্দেশক নয়।
* এমআরআই (MRI) বা সিটি স্ক্যান (CT Scan): যদি আলট্রাসাউন্ডের ফলাফল অস্পষ্ট থাকে বা আরও বিশদ তথ্যের প্রয়োজন হয়।
২. পর্যবেক্ষণে রাখা (Watchful Waiting)
অধিকাংশ কার্যকরী সিস্ট কোনো চিকিৎসা ছাড়াই কয়েক মাস (সাধারণত ২-৩ মাসিক চক্র) এর মধ্যে নিজে থেকেই মিলিয়ে যায়। যদি সিস্ট ছোট হয়, কোনো উপসর্গ না থাকে এবং ক্যান্সার-সন্দেহজনক না হয়, তাহলে ডাক্তার এটিকে পর্যবেক্ষণে রাখার (Watchful Waiting) পরামর্শ দিতে পারেন। এই সময়ে ডাক্তার নিয়মিত আলট্রাসাউন্ড করে সিস্টের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করবেন।
৩. উপসর্গ ব্যবস্থাপনা
যদি সিস্টের কারণে ব্যথা বা অস্বস্তি হয়, ডাক্তার কিছু ব্যথা উপশমকারী ওষুধ (যেমন NSAIDs) দিতে পারেন। হট ওয়াটার ব্যাগ ব্যবহার করেও ব্যথা কমানো যেতে পারে।
৪. চিকিৎসা পদ্ধতি
কিছু ক্ষেত্রে সিস্টের জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে:
* জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল (Oral Contraceptives): কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তার জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারেন। এটি সিস্টের আকার কমাতে বা নতুন সিস্ট তৈরি হওয়া আটকাতে সাহায্য করে, বিশেষ করে কার্যকরী সিস্টের ক্ষেত্রে।
* সার্জারি (Surgery): যদি সিস্ট বড় হয়, ব্যথা বা অন্যান্য গুরুতর উপসর্গ সৃষ্টি করে, দ্রুত আকার পরিবর্তন করে, বা ক্যান্সারের সন্দেহ থাকে, তাহলে সার্জারির মাধ্যমে সিস্ট অপসারণের প্রয়োজন হতে পারে। সার্জারি সাধারণত দুইভাবে করা যায়:
* ল্যাপারোস্কোপি (Laparoscopy): এটি একটি minimally invasive প্রক্রিয়া। ছোট ছিদ্র করে ক্যামেরা এবং বিশেষ যন্ত্রপাতির সাহায্যে সিস্ট অপসারণ করা হয়। এটি দ্রুত সেরে ওঠার সুযোগ দেয়।
* ল্যাপারোটমি (Laparotomy): এটি ওপেন সার্জারি, যেখানে একটি বড় ছিদ্র করে সিস্ট অপসারণ করা হয়। এটি সাধারণত বড় বা জটিল সিস্টের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়, অথবা যদি ক্যান্সারের উচ্চ ঝুঁকি থাকে।
৫. জীবনযাত্রায় পরিবর্তন (বিশেষত PCOS-এর ক্ষেত্রে)
যদি সিস্ট পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS) এর সাথে সম্পর্কিত হয়, তাহলে জীবনযাত্রার কিছু পরিবর্তন বেশ কার্যকর হতে পারে:
* স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত (Low GI) খাবার, প্রচুর ফল, শাকসবজি এবং আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া। প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং চিনি পরিহার করা।
* নিয়মিত ব্যায়াম: ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
* ওজন নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত ওজন PCOS-এর লক্ষণগুলো বাড়িয়ে দেয়, তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা:
* যদি হঠাৎ করে তীব্র পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব, জ্বর বা মাথা ঘোরার মতো লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে জরুরি চিকিৎসা কেন্দ্রে যোগাযোগ করুন। এটি সিস্ট ফেটে যাওয়া (ruptured cyst) বা সিস্টে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার (ovarian torsion) লক্ষণ হতে পারে, যা জরুরি অবস্থা।
* চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের ঘরোয়া চিকিৎসা বা হারবাল ঔষধ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
ডিম্বাশয়ের সিস্ট একটি সাধারণ সমস্যা হলেও, সঠিক সময়ে এর কারণ ও ধরন নির্ণয় করে উপযুক্ত চিকিৎসা নেওয়া খুবই জরুরি। আপনার স্বাস্থ্য সম্পর্কে কোনো উদ্বেগ থাকলে নির্দ্বিধায় চিকিৎসকের সাথে কথা বলুন।
Post a Comment